‘জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম’ ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি রাহিমাহুল্লাহ রচিত অষ্টম হিজরি শতকের এক অনন্য গ্রন্থ, যা ইসলামি জ্ঞান, হাদিসের ব্যাখ্যা, এবং আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রে এক অতুলনীয় সংযোজন। প্রায় সাতশো বছর ধরে উলামাদের নিকট সর্বময় সমাদৃত এ বইটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
১. হাদিসভিত্তিক শিক্ষার সারসংকলন
বইটি ইমাম নববির নির্বাচিত ৪২টি হাদিসের ওপর ভিত্তি করে লেখা, যেগুলো ইসলামের মৌলিক নীতিমালা বিষয়ে সংকলিত। ইমাম ইবনু রজব এতে আরও ৮টি হাদিস যোগ করে প্রতিটি হাদিসের গভীর ব্যাখ্যা, ব্যাকরণ ও বিধানগত বিশ্লেষণ এবং বাস্তব জীবনে এর প্রায়োগিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন।
২. ইলম (জ্ঞান) ও হিকমাহ (প্রজ্ঞা)-এর সমন্বয়
বইটির নামের অর্থই ‘জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সমন্বয়কারী’। এতে ইসলামি চিন্তাধারার বিভিন্ন শাখা যেমন আকিদা, ফিকহ, আখলাক, তাসাওউফ, এবং আত্মশুদ্ধির বিষয়গুলো অত্যন্ত সুন্দরভাবে একত্র করা হয়েছে; যা একজন মুমিনের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক, উভয় দিককার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. কুরআন ও হাদিসের গভীর বিশ্লেষণ
ইমাম ইবনু রজব কুরআনের আয়াত এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য হাদিসের আলোকে প্রতিটি বিষয়ের প্রয়োজনীয় সমর্থন দিয়েছেন। বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি শরিয়তের মৌলিক নুসুস ও মূলনীতিগুলো একত্র করেছেন, যা পাঠককে প্রমাণ-ভিত্তিক ইসলামি জ্ঞানের সাথে পরিচিত করবে।
৪. আলিমদের বক্তব্যের সমৃদ্ধ সংকলন
গ্রন্থটিতে সাহাবা, তাবেয়িন এবং পরবর্তী যুগের ইমাম ও যুগশ্রেষ্ঠ আলিমদের মূল্যবান মন্তব্য, মতামত ও ব্যাখ্যার সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে, যা বইটিকে আরও প্রাঞ্জল ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। ফলে যুগ যুগ ধরে বইটি সর্বমহলে গ্রহণীয় হয়ে আসছে।
৫. প্রাসঙ্গিক উদাহরণ ও উপমা
বিভিন্ন ঘটনা, উদাহরণ, এবং জীবনের বাস্তব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে পাঠকদের জন্য বিষয়গুলো আরও জীবন্ত উপায়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে প্রাসঙ্গিক মূলনীতি, ফিকহ ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্দেশনাগুলো পাঠকের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
৬. আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির দিক-নির্দেশনা
বইটিতে শুধু বাহ্যিক আমল নয়, বরং অন্তরের ইখলাস, নফসের পরিশুদ্ধি, তাকওয়া, সবর, বিনয়, এবং মানবীয় আন্তরিকতা বৃদ্ধির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা রয়েছে। বইটি পড়ার মধ্য দিয়ে পাঠক নিজের ভেতর ও বাহির উভয় দিক যথাযথ উপায়ে সংশোধন করে নিতে পারবেন।
৭. সাধারণ পাঠকের জন্য সহজবোধ্য উপস্থাপন
যদিও বইটি শাস্ত্রীয়ভাবে সমৃদ্ধ এবং বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিস্তৃত, তবে এর ভাষা খুবই সহজ ও বোধগম্য, যা সাধারণ পাঠকও অনায়াসে বুঝতে পারবে। প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও নুসুসের আলোকে এতে ইলমের গভীর বিষয়গুলো সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
৮. সর্বাঙ্গীণ ইসলামি জীবনবোধ
ইবাদাত, আখলাক, সামাজিক দায়িত্ব, ব্যাবসায়িক নীতিমালা, পারিবারিক জীবন—সবকিছুর জন্য প্রাসঙ্গিক নির্দেশনা প্রদান করে ‘জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম’। একে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি জীবনদর্শনের আকরগ্রন্থ বললেও ভুল হবে না; বইটি বরং সেটাই।
৯. মৌলিক চিন্তাভাবনার ছোঁয়া
নির্বাচিত হাদিসগুলো থেকে মৌলিক শিক্ষা ও বিধান উৎসারণের পাশাপাশি ইমাম ইবনু রজব এখানে তাঁর নিজস্ব বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করেছেন, যা পাঠককে নতুনভাবে চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করবে। ইবনে রজবের ব্যাখ্যা সর্বদা মৌলিক এবং চিন্তাশীল। ফলে পাঠক এখানে যথেষ্ট চিন্তার খোরাক পাবেন। তার কৌতূহলী ও সৃজনশীল মন তৃপ্ত হতে পারবে।
১০. দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
এটি ‘পড়ে রেখে দিলাম এবং ভুলে গেলাম’ জাতীয় কিছু নয়; বরং বারবার পাঠ করে আত্মমূল্যায়ন ও চরিত্র গঠনের জন্য অনন্য সহায়ক এ বই। কালের হরফে লেখা এ গ্রন্থ পাঠকের অন্তরে ইলমের দীপ্তি ছড়িয়ে দেয় এবং তার জীবনের মোড় পরিবর্তনে সাহায্য করে।
‘জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম’ কেবল একটি বই নয়, বরং এর প্রসঙ্গ ও দীর্ঘ কলেবর যেন ইলম ও আধ্যাত্মিকতার লম্বা সফর। এ বই পাঠকের হৃদয়কে জাগ্রত করে, চিন্তাকে শানিত করে এবং আত্মা পরিশুদ্ধ করতে সহায়তা করে। ইসলামি জ্ঞানপিপাসু, আলিম, ছাত্র, এবং সাধারণ মুসলিম—সবার জন্যই এই কিতাব এক অনবদ্য রত্ন।